শরীর আমার সিদ্ধান্ত আমার: একটি যুক্তিভিত্তিক পর্যালোচনা
আধুনিক বিশ্বে ব্যক্তি স্বাধীনতার ধারণা দিন দিন চূড়ান্ত রূপ নিচ্ছে। “শরীর আমার, সিদ্ধান্ত আমার”—এই স্লোগানটি তারই একটি বহুল আলোচিত প্রতিফলন, যা মূলত ব্যক্তি স্বাধীনতা, নারীর অধিকার এবং আত্মনিয়ন্ত্রণের দাবিকে সামনে এনে দাঁড় করায়। প্রথম দৃষ্টিতে এটি যৌক্তিক, মানবিক ও স্বাধীনতাপ্রিয় মনোভাবের বহিঃপ্রকাশ মনে হলেও, গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে এতে বহু দর্শনগত অসঙ্গতি, নৈতিক দুর্বলতা এবং বাস্তবতার সঙ্গে বিরোধ প্রতিভাত হয়।
এই স্লোগানটি এমন একটি পরিপূর্ণ ব্যক্তিস্বাধীনতার দাবি করে, যা বাস্তব ও সামাজিক কাঠামোর পরিপন্থী। এটি সমাজ, নীতি ও দায়িত্বের মৌলিক ধারণাগুলোকেও অবজ্ঞা করে। এই লেখায় আমরা ধর্ম, যুক্তি, দর্শন এবং সামাজিক বাস্তবতার আলোকে এই দাবিটির দুর্বলতা ও বিপজ্জনক দিকগুলো বিশ্লেষণ করব।
যুক্তির আলোকে বিশ্লেষণ
“শরীর আমার, সিদ্ধান্ত আমার” এই স্লোগানটি ধরে নেয় যে, ব্যক্তির শরীরের উপর তার চূড়ান্ত ও পূর্ণ মালিকানা রয়েছে। কিন্তু বাস্তবতা আমাদের ভিন্ন কিছু শেখায়। যেই শরীরকে আমি নিজের দাবি করছি, সেটি আসলে কতটা আমার? আমার শরীরের গঠন, গায়ের রং, উচ্চতা, জন্মস্থান, এমনকি আমার বাবা-মাও আমি নিজে নির্ধারণ করিনি। আমার আয়ু, স্বাস্থ্য, বা শারীরিক সক্ষমতাও আমার ইচ্ছাধীন নয়। যদি এই মৌলিক বিষয়গুলো আমি নিজে নির্ধারণ না করতে পারি, তাহলে কীভাবে বলা যায়—এই শরীরের আমি চূড়ান্ত মালিক?
আমরা কি কেউ সম্পূর্ণ স্বাধীন? আমি যদি এখনই প্রযুক্তির সহায়তা ছাড়া আকাশে উড়তে চাই, সেটা কি সম্ভব? আমার ইচ্ছে থাকলেই কি আমি সব করতে পারি? বাস্তবতা বলে—না, পারি না। তাই কোনো সিদ্ধান্ত শুধু ইচ্ছার ওপর ভিত্তি করে নেওয়া যায় না।
আমাদের ইচ্ছাগুলো সামাজিক মূল্যবোধ, নীতি-নৈতিকতা এবং আইন দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। যেমন, আমি ইচ্ছা করলেই নিজের হাত কেটে ফেলতে পারি না; কারণ এটি শুধু আমার বিষয় নয়—এতে চিকিৎসা, নৈতিকতা ও আইন জড়িত। ঠিক তেমনিভাবে জনসমক্ষে নগ্নতা শুধু শরীরের ব্যবহার নয়, বরং সমাজের নৈতিকতা, শিশুদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং যৌন সহিংসতার সম্ভাবনাকেও স্পর্শ করে। এসব বিষয় প্রমাণ করে, শরীর ও সিদ্ধান্ত একক ব্যক্তির সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে নয়।
নৈতিক আপেক্ষিকতা বনাম সার্বজনীনতা
এই স্লোগানের পেছনে “নৈতিক আপেক্ষিকতা” (moral relativism)-এর একটি চূড়ান্ত রূপ কাজ করে, যেখানে প্রত্যেকেই নিজের মতো করে সঠিক-ভুল নির্ধারণ করে। একে বলা যায়—”যা আমার কাছে ঠিক, সেটাই ঠিক”। কিন্তু সমাজে বসবাসকারী একটি নৈতিক কাঠামোর মধ্যে এই চিন্তা বিপজ্জনক। ধরা যাক, কেউ বলে “আমার শরীর, আমি আত্মহত্যা করব।” এটি তার ব্যক্তিগত সিদ্ধান্ত হলেও এর ফল সমাজ, পরিবার ও আইন ব্যবস্থায় মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। এটি শুধু তার জীবনেই নয়, আশেপাশের বহু মানুষের জীবনেও আঘাত হানে।
প্রকৃতপক্ষে, নৈতিকতা শুধুই ব্যক্তিগত নয়, বরং সার্বজনীন অনেক নীতির ভিত্তিতে গঠিত। “ভালো” এবং “মন্দ” – এই ধারণাগুলো শুধুই কারো ইচ্ছার ওপর নির্ভর করলে সমাজ বিশৃঙ্খলায় ভরে যাবে। তখন একজন ধর্ষকও বলবে ‘শরীর আমার, সিদ্ধান্ত আমার’ তাই সে ধর্ষণ করতেই পারে। তাই “শরীর আমার, সিদ্ধান্ত আমার”—এই দাবিটি শুধু যুক্তিগতভাবে দুর্বল নয়, বরং সমাজের জন্যও হুমকিস্বরূপ।
ইসলামী দৃষ্টিকোণ
ইসলামের দৃষ্টিতে, মানুষ তার শরীরের মালিক নয়; বরং এটি আল্লাহর পক্ষ থেকে অর্পিত একটি আমানত (trust)। কুরআনে বলা হয়েছে:
“নিশ্চয়ই আল্লাহ মুমিনদের নিকট থেকে তাদের জান ও মাল কিনে নিয়েছেন…”
— (সূরা আত-তাওবাহ, ৯:১১১)
অর্থাৎ, মানুষের জীবন ও দেহ তার নিজস্ব ভোগের জন্য নয়; বরং তা আল্লাহর বিধান অনুযায়ী পরিচালনার জন্য দেওয়া হয়েছে।
ইসলাম মানুষকে সিদ্ধান্ত গ্রহণের স্বাধীনতা দেয়, তবে তা নির্দিষ্ট সীমার মধ্যে। যেমন: নগ্নতা, আত্মহত্যা, অবৈধ যৌন সম্পর্ক ইত্যাদি শরীরসংক্রান্ত অনেক কর্মকাণ্ড ইসলাম হারাম ঘোষণা করেছে, যদিও কেউ এসবকে “নিজের শরীরের ওপর অধিকার” হিসেবে দাবি করে। কারণ এগুলো ব্যক্তিগত হলেও তার প্রভাব সমাজ, নৈতিকতা ও পরকাল পর্যন্ত বিস্তৃত।
আসলে, আখিরাতে শরীরের প্রতিটি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের ব্যবহার সম্পর্কে জবাবদিহি করতে হবে:
“স্মরণ করো সেই দিন, যেদিন তোমরা জিজ্ঞাসিত হবে তোমাদের নেয়ামত সম্পর্কে।” 1
যদি শরীর সত্যিই কেবল আমার সম্পত্তি হতো, তাহলে জবাবদিহির কোনো প্রশ্নই উঠত না। সুতরাং শরীরের উপর চূড়ান্ত মালিকানা আল্লাহর, আমার নয়।
এই বিশ্লেষণ থেকে স্পষ্ট যে, “শরীর আমার সিদ্ধান্ত আমার” একটি অতিসরলীকৃত, আত্মকেন্দ্রিক ও যুক্তিবিচ্যুত স্লোগান, যা ব্যক্তি স্বাধীনতার নামে সামাজিক ও নৈতিক কাঠামোকে নস্যাৎ করতে চায়। বাস্তবতা, দর্শন, নৈতিকতা এবং ইসলামী বিশ্বাস—সব দিক থেকেই এই স্লোগানের দাবি প্রশ্নবিদ্ধ।
আমাদের শরীর একটি নিয়ামত, আর সিদ্ধান্ত একটি দায়িত্ব—উভয়ের মালিকানা আল্লাহর হাতে। মানুষ তার স্বাধীনতা চর্চা করবে সীমার মধ্যে, দায়িত্বের সঙ্গে, এবং সেই পরিপ্রেক্ষিতেই প্রকৃত স্বাধীনতা ও মর্যাদা নিহিত।
রেফারেন্স- সূরা তাকাসুর: ৮ [↩]