সৃষ্টিকর্তাকে কে সৃষ্টি করেছে?
সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্ব সম্পর্কিত নাস্তিকদের সাধারণ যে আপত্তি শোনা যায়, তা হলো—‘যদি সব কিছুর সৃষ্টিকর্তা থাকে, তাহলে সৃষ্টিকর্তাকে কে সৃষ্টি করেছে?’ বা আল্লাহকে কে সৃষ্টি করেছে? তবে, এই প্রশ্নটি অত্যন্ত অবান্তর এবং শিশুসুলভ। মহাবিশ্বের অস্তিত্বের জন্য যে সর্বশক্তিমান, চিরন্তন সত্তার প্রমাণ রয়েছে, সেক্ষেত্রে সৃষ্টিকর্তাকে কে সৃষ্টি করেছে, এমন প্রশ্ন একটি অদ্ভুত অর্থহীনতা। আসুন, এই বিষয়টি একটু গভীরভাবে ব্যাখ্যা করি ।
সর্বশক্তিমান সৃষ্টিকর্তা এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন। তবে, তিনি সৃষ্ট নয়; বরং তিনি স্রষ্টা । স্রষ্টা এই জগতের নিয়মকানুনের গণ্ডিতে আবদ্ধ নন । আমাদের পৃথিবীর প্রতিটি বস্তুর অস্তিত্বের কানো-না-কোনো কিছুর উপর নির্ভরশীল। যেমন আপনি যে মোবাইল ফোনটি ব্যবহার করছেন, তার অস্তিত্ব একাধিক উপাদানের উপর নির্ভরশীল। আর সেই উপাদানগুলোও অন্য কিছুতে নির্ভরশীল। এমন নির্ভরশীলতা আমরা প্রতিটি বস্তুতেই দেখতে পাই, তবে সৃষ্টিকর্তা কি মহাবিশ্বের অংশ? তাকে কি মহাবিশ্বে খুঁজে পাবো? আপনি কি কখনো ফোনের মধ্যে ফোন নির্মাতাকে খুঁজে পাবেন? বা, কাঠ মিস্ত্রিকে তার বানানো চেয়ারটির মধ্যে খুঁজে পাবেন?
সৃষ্টিকর্তা এই মহাবিশ্ব সৃষ্টি করেছেন, তাই তিনি এই মহাবিশ্ব থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। আমাদের মহাবিশ্বের সব কিছুই কোনো না কোনোভাবে নির্ভরশীল; কিন্তু সৃষ্টিকর্তা এমন কিছু যা কোনো বাহ্যিক কিছুতে নির্ভরশীল নয়। কারণ তিনি অনিবার্য সত্তা, চিরন্তন সত্তা, তার অস্তিত্ব থাকা বাধ্যতামূলক । যেহেতু সৃষ্টির সব কিছু নির্ভরশীল, তাই সৃষ্টিকর্তার অস্তিত্বেও যদি এমন নির্ভরশীলতার প্রয়োগ করা হয়, তবে তা সৃষ্টিকর্তার প্রকৃতির সঙ্গে সাংঘর্ষিক হয়ে পড়বে। আমরা আমাদের অস্তিত্বের কারণ খুঁজতে গিয়ে সৃষ্টিকর্তার ধারণা পেয়ে থাকি। সৃষ্টিকর্তা এমন কিছু নয় যাকে আমরা স্বচক্ষে (Empirically) দেখতে পাবো। সম্ভাব্য অস্তিত্বশীল সব কিছুর অস্তিত্বের জন্য যদি কোনো-না- কোনো কিছুর উপর নির্ভরশীল। একারণে যদি চিরন্তন সত্তাও তার অস্তিত্বে আসার জন্য কোনো কিছুর উপর নির্ভরশীল হয়, তাহলে চিরন্তন সত্তা ও সসীম সত্তার মধ্যে পার্থক্য রইলো কোথায় ?
স্রষ্টা এবং সৃষ্টি দুটোই আলাদা ক্যাটাগরি। একটা ক্যাটাগরির কোন নিয়ম অন্য ক্যাটাগরিতেও একইভাবে প্রযোজ্য হবে এমন অনুমান করে নেওয়া এক ধরনের ভ্রান্তি যা ক্যাটাগরি মিস্টেক ফ্যালাসি নামে পরিচিত। ‘সৃষ্টিকর্তাকে কে সৃষ্টি করেছে?’ এই প্রশ্নটি কেবল একটি ফ্যালাসি। সৃষ্টিকর্তা এবং সৃষ্টির মধ্যে তফাত বুঝতে পারলে এই ধরনের প্রশ্ন একেবারেই অবান্তর। বিবাহিত এবং কুমার যেমন একই ক্যাটাগরিতে পরেনা, তেমনি পার্টিকুলার এবং অসীমও একই ক্যাটাগরিতে পরে না ।
এছাড়া, সৃষ্টি ও স্রষ্টার মৌলিক পার্থক্য বুঝতে পারলে এ ধরনের অবান্তর প্রশ্নে মাথা ঘুরপাক খাওয়ার অবকাশ নেই। সৃষ্টি বলতে আমরা বুঝি, এমন কিছু যা কোনো এক সময় অস্তিত্বে ছিল না এবং নির্দিষ্ট এক মুহূর্তে অস্তিত্বে এসেছে। কিন্তু নাস্তিকদের প্রশ্ন অনুযায়ী যদি আমরা মেনেও নেওয়া হয় যে
সৃষ্টিকর্তারও স্রষ্টা থাকা আবশ্যক, তাহলে এর মানে দাঁড়ায়, সৃষ্টিকর্তা একসময় অস্তিত্বে ছিল না, এবং এক নির্দিষ্ট সময়ে তার অস্তিত্ব শুরু হয়েছে। এখন, যেসব নাস্তিকরা এমন চমকপ্রদ প্রশ্ন দিয়ে মানুষের চিন্তায় বিভ্রান্তি সৃষ্টির চেষ্টা করছেন, তাদের কাছে আমার একটিই প্রশ্ন যদি সৃষ্টিকর্তারও সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক, তবে তিনি কি সৃষ্টিকর্তা হিসেবে অবিরত থাকবেন, নাকি সৃষ্ট হয়ে যাবেন?
নাস্তিকদের এই প্রশ্নটি আসলে একটি মৌলিক যুক্তির বিশাল দুর্বলতা প্রকাশ করে, যা স্রষ্টার প্রকৃতিকে একেবারেই অস্বীকার করে। যদি সৃষ্টিকর্তার সৃষ্টি হওয়া আবশ্যক হয়, তবে সে আর স্রষ্টা থাকতে পারে না, বরং সে নিজেই সৃষ্ট হয়ে যাবে, এবং সৃষ্টিকর্তার সত্তা ও তার অস্তিত্বের স্বতন্ত্রতা ধ্বংস হয়ে যাবে। মনে করুন, X হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা। যদি X, XI থেকে সৃষ্টি লাভ করে, তাহলে X কি সৃষ্টিকর্তা হিসেবে পরিচিত থাকবে, নাকি সৃষ্ট হয়ে যাবে? স্পষ্টভাবেই, X সৃষ্ট হবে, সৃষ্টিকর্তা থাকবে না। এই যুক্তি অনুসারে, সৃষ্টিকর্তাকেই যদি সৃষ্ট হতে হয়, তবে তা সৃষ্টিকর্তার প্রকৃতির মৌলিক বিপরীত অবস্থান তৈরি করে, এটি তার চিরন্তন ও অসীম সত্তার সাথে একেবারেই সাংঘর্ষিক। সৃষ্টির জন্য সৃষ্টিকর্তার কোনো বাহ্যিক উপাদান বা কারণ থাকা অসম্ভব, কারণ তিনি নিজেই চিরন্তন ও অসীম সত্তা, যার অস্তিত্ব স্বতন্ত্র এবং কোনো শর্তাধীন নয়। সুতরাং, এই প্রশ্নটি যুক্তিবিদ্যার মূলনীতির সাথে পুরোপুরি সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে।
এছাড়া, ‘সৃষ্টিকর্তাকে কে সৃষ্টি করেছে?’ এই প্রশ্নটি একটি লোডেড কোশ্চেন ফ্যালাসি, বা কমপ্লেক্স কোশ্চেন ফ্যালাসি । এখানে controversial বা unjustified assumption করা হয়। কারণ, এতে প্রশ্নকারীর মধ্যে এক ধরনের পূর্বধারণা থাকে, সে আগেই ধারণা করে নিয়েছে যে সৃষ্টিকর্তাকে সৃষ্টি হতে হবে। কিন্তু, আসলে এটি শুধু একটি অনুমান, যা কোনো প্রমাণ দ্বারা সমর্থিত নয়। এই ধরনের প্রশ্ন অনেকটা এমন, যেমন কেউ আপনাকে হঠাৎ করে প্রশ্ন করবে, “আপনি কি এখনো বউ পেটান?” এই প্রশ্নকারী, আসলে, আগে থেকেই ধরে নিয়েছে যে আপনার বউ আছে এবং আপনি তাকে নির্যাতন করেন। সৃষ্টিকর্তা, যিনি অসীম সত্তা, তার কোনো শুরুও নেই, তিনি অসৃষ্ট। অর্থাৎ, তার অস্তিত্বের কোনো শুরু নেই, এবং তিনি কোনো নির্দিষ্ট মুহূর্তে সৃষ্টি হয়নি। তাই, তার অস্তিত্বকে সৃষ্টির সাথে যুক্ত করা বা তাকে সৃষ্টি করার ধারণা একেবারেই অসম্ভব।
সৃষ্টিকর্তার সংজ্ঞা অনুযায়ী, তিনি এক অসৃষ্ট স্রষ্টা, যার অস্তিত্ব কোনো অনস্তিত্ব থেকে উদ্ভূত হয়নি। তার অস্তিত্বের কোনো শুরু নেই, কারণ তিনি অসীম সত্তা। অসীম সত্তার জন্য কোনো বাহ্যিক সৃষ্টির প্রয়োজন নেই। ধরুন, X হচ্ছে সৃষ্টিকর্তা এবং তিনি অসীম সত্তা যার কোনো শুরু নেই। এখন যদি আমরা ধরে নিই, X, X1 থেকে সৃষ্টি লাভ করেছে, তখন একটি প্রশ্ন উঠবে-তাহলে XI কে সৃষ্টি করেছে? যদি বলা হয়, X1 X2 থেকে সৃষ্টি লাভ করেছে, তবে প্রশ্ন হবে X2 কে সৃষ্টি করেছে? এভাবে, যদি প্রশ্নের ধারা অব্যাহত থাকে, তাহলে আপনি অসীম সংখ্যকবার প্রশ্ন করতে পারবেন। এইভাবে চলতে থাকলে, প্রশ্নের উত্তর কখনোই শেষ হবে না। কারণ, X অস্তিত্বের জন্য X1 এর উপর নির্ভরশীল, X1 অস্তিত্বের জন্য X2 এর উপর নির্ভরশীল, X2 অস্তিত্বের জন্য X3 এর উপর নির্ভরশীল, এই ধারা অব্যাহত। এভাবে নির্ভরশীলতার অবিরত ক্রমের মধ্যে আমাদের কখনোই বর্তমান সময়ে পৌঁছানোর সুযোগ ছিল না। এমন একটি অনাদিকাল বা অসীম কালব্যাপী চলতে থাকা সৃষ্টির নির্ভরশীলতার পরিণতি হবে ‘অসীম প্রত্যাবর্তন’ (Infinite Regress), য কোনো ফলপ্রসূ সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে দেবে না। আর, এমন চলমান নির্ভরশীলতার এক অনন্ত চক্রে বর্তমান অস্তিত্ব কখনোই নিশ্চিত হতে পারত না। সুতরাং সৃষ্টির জন্য একমাত্র একটি স্রষ্টা থাকা একান্ত অনিবার্য, যিনি চিরন্তন, এবং যার কোনো স্রষ্টা নেই—এটি একমাত্র সমাধান হতে পারে।
এছাড়াও, Law of parsimony ( মিতব্যয়িতা নিয়ম) অনুসারে, একই জিনিসের একটি মাত্র কারণ থাকা সম্ভব। তাহলে এই ইউনিভার্সের একটি মাত্র কারণ থাকা সম্ভব। এবং সেই কারণই হলো সৃষ্টিকর্তা।
কুরআনের মত
পবিত্র কুরআনে আল্লাহ সুবাহানাহুওয়া তা’আলা বলেন,
বল, তিনিই আল্লাহ, এক অদ্বিতীয়। আল্লাহ কারো মুখাপেক্ষী নন, সকলেই তার মুখাপেক্ষী। তিনি কাউে জন্ম দেননি এবং তাকেও জন্ম দেওয়া হয়নি। 1
দার্শনিকদের মতামত
অধ্যাপক এন্থনি ফ্লিউয়ের ‘দেয়ার ইজ গড’ বইয়ের পরিশিষ্টে অধ্যাপক আব্রাহাম ভার্গসে জোরালোভাবে বলেছে,
রেফারেন্সআস্তিক নাস্তিক একটি বিষয়ে একমত হতে পারে যদি কোনো কিছুর অস্তিত্ব থাকে, তা হলে এর আগে অবশ্যই এমন কিছু থাকতে হবে যা সব সময় অস্তিত্বশীল। চিরকালীন অস্তিত্ববান এই সত্তা কীভাবে এসেছে এর উত্তর হলো, এটা কোনোভাবেই আসেনি। এটা সব সময় অস্তিত্ববান। 2
- (১১২) আল-ইখলাস | (112) Al-Ikhlas | سورة الإخلاص-অনুবাদ/তাফসীর [↩]
- দেয়ার ইজ এ গভ: হাউ দ্য ওয়ার্ল্ডস মোস্ট নতরিয়াস এবিস্ট চেইনজড হিজ মাইল্ড | পৃষ্ঠা নঃ ১৫৬ [↩]