Insight Zone

নাস্তিক্যবাদ পরিচিতি

নাস্তিক্যবাদ পরিচিতিঃ ধারণা, উৎপত্তি এবং একটি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ

নাস্তিক্যবাদ পরিচিতিঃ ধারণা, উৎপত্তি এবং একটি সমালোচনামূলক বিশ্লেষণ

সাধারণত যে মতবাদ স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করে না তাকে নাস্তিক্যবাদ বলে। এই মতবাদ অনুসারে জড় জগৎ হচ্ছে একমাত্র জগৎ, আর এই জগতের আড়ালে কোনো স্রষ্টা বা আধ্যাত্মিক শক্তির অস্তিত্ব নেই। আমাদের এই মহাবিশ্ব কেবল জড় ও জড় শক্তির খেলা। এই জগতের কোনো উদ্দেশ্য নেই। যান্ত্রিকভাবেই এই জগৎ চলমান। সুতরাং, এই জগৎ পরিচালনায় কোনো উদ্দেশ্য বা অতিপ্রাকৃতিক সত্তার প্রয়োজন নেই। 

Stanford Encyclopedia of Philosophy এর মতে, নাস্তিকতা হল একটি মনস্তাত্ত্বিক অবস্থা, বিশেষত একজন নাস্তিক হওয়ার অবস্থা হলো, যেখানে একজন নাস্তিককে এমন একজন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, যে আস্তিক নয় (একজন আস্তিককে এমন একজন হিসেবে সংজ্ঞায়িত করা হয় যে বিশ্বাস করে যে ঈশ্বরের অস্তিত্ব রয়েছে) এটা নিম্নলিখিত এই সংজ্ঞা তৈরি করে, নাস্তিকতা হল ঈশ্বরের অস্তিত্ব আছে এমন বিশ্বাসের অভাবের মানসিক অবস্থা। 1

Merriam Webster dictionary এর মতে, নাস্তিকতা হলো বিশ্বাসের অভাব বা দেবতা বা কোনো দেবতার অস্তিত্বে দৃঢ় অবিশ্বাস/স্রষ্টা বা দেবতারদের প্রতি বিশ্বাসের অভাব অথবা দৃঢ় অবিশ্বাস। 2

Cambridge dictionary মতে, নাস্তিকতা হচ্ছে স্রষ্টা বা দেবতার প্রতি অবিশ্বাসের ঘটনা, বা কোনো স্রষ্টা বা দেবতা নেই এমন বিশ্বাস। 3

মোনাস ইউনিভার্সিটির দর্শনের অধ্যাপক ও অস্ট্রেলিয়ান অ্যাসোসিয়েশন অফ ফিলোসফির সিইও গ্রাহাম ওপি তার লিখিত ‘ATHEISM AND AGNOSTICISM’ বইতে নাস্তিকতার সংজ্ঞা দিতে গিয়ে লিখেছেন,

যে বৈশিষ্ট্যগুলি মানুষকে নাস্তিক এবং আজ্ঞেয়বাদী করে তোলে – তাদের (নাস্তিকদের) কোনো স্রষ্টা নেই এমন দাবির প্রতি মনোভাব। নাস্তিকরা বিশ্বাস করে তাদের কোনো স্রষ্টা নেই। তাই উপযুক্ত পরিস্থিতিতে নাস্তিকরা নিশ্চিত করে যে তাদের কোনো স্রষ্টা নেই। 4

বিখ্যাত নাস্তিক দার্শনিক রিচার্ড ডকিন্স তার লিখিত ‘The God Delusion’ গ্রন্থে দার্শনিক প্রকৃতিবাদ সম্পর্কে বলেন,

দার্শনিক প্রকৃতিবাদ অর্থে নাস্তিক হলো এমন কেউ, যে বিশ্বাস করে প্রকৃতি, ভৌত জগৎ, পর্যবেক্ষণযোগ্য মহাবিশ্বের পিছনে কোনো অতিপ্রাকৃতিক সৃজনশীল বুদ্ধিমান সত্তা লুকিয়ে নেই যিনি চুপিসারে অবস্থান করছেন। কোনো আত্মা নেই যেটা শরীর থেকে বেরিয়ে যায়, নেই কোনো অলৌকিক কিছু। আছে কেবল জাগতিক ঘটনাবলি, যা আমরা এখনো বুঝতে পারিনি। 5

উপরিউক্ত সংজ্ঞাগুলো থেকে আমরা এই সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে, নাস্তিকতার মানে কোনো অতিপ্রাকৃতিক সত্তা বা সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাস করা অথবা অস্বীকার করা।

সৃষ্টিকর্তায় অবিশ্বাস বা অস্বীকার করার পক্ষে কি সুস্পষ্ট কোন যুক্তি প্রমাণ নাস্তিকদের নিকট আছে? তারা কি অন্ধভাবে এই দাবিটি মেনে নিয়েছে যে, স্রষ্টা বা অতিপ্রাকৃতিক কোনো সত্তার অস্তিত্ব নেই? নাকি যুক্তি প্রমাণের উপর ভিত্তি করেই তারা স্রষ্টার অস্তিত্ব নাকোচ করে? নাস্তিকদের উচিত তাদের দাবির স্বপক্ষে সুস্পষ্ট যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করা। আর তারা যদি বলে, স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে আস্তিকরা যে ধরনের যুক্তি উপস্থাপন করে তা তাদের নিকট বোধগম্য নয়, অথবা আস্তিকরা স্রষ্টার অস্তিত্বের কোন প্রমাণ দিতে পারেনি বিধায় স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার বা অবিশ্বাস করে, তাহলে ব্যাপারটিকে আর নাস্তিক্যবাদের মধ্যে ফেলা যায় না! ব্যাপারটা তখন ‘স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় আছে’ এমন একটি অবস্থান হবে। কারণ, সঠিক যুক্তি প্রমাণ তাদের সামনে উপস্থাপন করতে পারলে তারা সৃষ্টিকর্তা বা অতিপ্রাকৃতিক কোন সত্তার অস্তিত্বে বিশ্বাস করতেও পারে।

কেউ কোন কিছু সত্য প্রমাণ করতে পারেনি বলে তার ‘অস্তিত্ব নেই’ অথবা, কেউ কোন কিছু ভুল প্রমাণ করতে পারেনি বলে তার ‘অস্তিত্ব আছে’ এ ধরনের বিশ্বাস মূলত এক ধরণের যৌক্তিক ভ্রান্তি। যুক্তিবিদ্যার ভাষায় যাকে বলে Argument from ignorance. এই যৌক্তিক ভ্রান্তি তখনই ঘটে যখন একটি প্রস্তাবকে সত্য বলে মেনে নেওয়া হয় কারণ এটি এখনও মিথ্যা প্রমাণিত হয়নি বা একটি প্রস্তাবকে মিথ্যা বলে মেনে নেওয়া হয় কারণ এটি এখনও সত্য বলে প্রমাণিত হয়নি। উদাহরণস্বরূপ, ‘ক’ মিথ্যা। কারণ এর সত্যতার পক্ষে কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি। আবার ‘ক’ সত্য। কারণ একে মিথ্যা প্রমাণ করা যায়নি। আস্তিক এবং নাস্তিক উভয় এই কুযুক্তিটি করতে পারে। অর্থাৎ, কোনো আস্তিক যদি দাবি করে যেহেতু নাস্তিকরা প্রমাণ করতে পারে নি যে, ‘স্রষ্টার অস্তিত্ব নেই’ তাই স্রষ্টার অস্তিত্ব আছে। আবার কোনো নাস্তিক যদি দাবি করে, যেহেতু আস্তিকরা ‘স্রষ্টার অস্তিত্ব আছে’ তা প্রমাণ করতে পারেনি তাই স্রষ্টার অস্তিত্ব নেই।

সুতরাং, আস্তিকরা স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে কোন ভালো যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করতে পারেনি অথবা কোন যুক্তি-প্রমাণই উপস্থাপন করতে পারেনি বিধায় যদি মেনে নেওয়া হয়, অতিপ্রাকৃতিক সত্তা বা স্রষ্টার অস্তিত্ব নেই, তাহলে তা অজ্ঞতামূলক ভ্রান্তি বলে বিবেচিত হবে। আর যদি নাস্তিকরা কোন প্রকার যুক্তি-প্রমাণ ছাড়াই শুধু মাত্র নিজের খেয়ালখুশির কারণে এহেন বিশ্বাস লালন করে যে, অতিপ্রাকৃতিক সত্তা বা সৃষ্টিকর্তা বলতে কিছু নেই, তাহলে তা অন্ধবিশ্বাসের মতোই একটি ব্যাপার।

কিছু নাস্তিক হয়ত বলতে পারে আমরা ‘প্রমাণের অভাবে স্রষ্টার অস্তিত্ব অবিশ্বাস করি’। যেহেতু স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে দাবি আস্তিকরা করে সেহেতু স্রষ্টা যে আছে তা প্রমাণ করার দায়িত্ব (Burden of proof) আস্তিকের উপর। প্রমাণের বোঝা কার উপর তা নিয়ে ‘আল্লাহর অস্তিত্ব প্রমাণের বোঝা কার উপর?  – Insight Zone’ লিখাতে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে। ‘প্রমাণের অভাবে অবিশ্বাস’ এই বিষয়ের উপর ফোকাস দেওয়া যাক। অবিশ্বাস মানে, কোন প্রস্তাবকে সত্য বা বাস্তব হিসেবে গ্রহণ করতে অস্বীকৃতি। তার মানে ‘প্রমাণের অভাবে অবিশ্বাস’ এই দাবিটিতে একজন নাস্তিক স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষের দাবিকে অস্বীকার বা প্রত্যাখ্যান করে কেবল মাত্র প্রমাণের অভাবে। কিন্তু কোনো কিছুর অস্তিত্ব আমাদের প্রমাণ পাওয়ার উপর নির্ভরশীল নয়। যা কিছু অস্তিত্বশীল, তার স্বপক্ষে আমরা প্রমাণ না পেলেও তা অস্তিত্বশীলই থাকবে। বিষয়টি এমন নয় যে আমরা প্রমাণ পেলাম তার অমনি করে কোন কিছু অস্তিত্বে চলে এসেছে। আমরা কোন কিছুর প্রমাণ পাওয়ার জন্য হলেও প্রমাণিত হওয়ার আগেই তাকে অস্তিত্বশীল হতে হবে। কাজেই,প্রমাণের অভাবে কোন কিছুর অস্তিত্ব প্রত্যাখ্যান করা অজ্ঞতা ভ্রান্তি যুক্তির শামিল।

এছাড়া, ‘প্রমাণের অভাবে অবিশ্বাস বা অস্বীকার’ কথাটির মানে হচ্ছে, প্রমাণ পাওয়ার সম্ভাব্য সকল অবস্থা সম্পর্কে তারা জেনেই এহেন সিদ্ধান্ত নিয়েছে। কিন্তু যেখানে আমরা মহাবিশ্বের মাত্র ৪/৫ শতাংশ বিষয় সম্পর্কে জানতে পারবো সেখানে স্রষ্টার অস্তিত্ব থাকার পক্ষে সম্ভাব্য সকল প্রমাণের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রত্যাখ্যান করা অসম্ভব একটি ব্যাপার। যখন কেউ প্রমাণের অভাবের কারণে অবিশ্বাস বা অস্বীকার প্রকাশ করে তখন সে দাবি করে যে, ‘প্রমাণের অভাব রয়েছে’। উদাহরণস্বরূপ, যদি কেউ দাবি করে যে তাদের একটি পোষা বিড়াল আছে কিন্তু এই দাবিকে সমর্থন করার জন্য কোনো প্রমাণ তারা প্রদান করেনি। তাই আপনি উত্তর দিয়েছেন যে, “প্রমাণের অভাবে আমি আপনার দাবিকে (তাদের একটি পোষা বিড়াল আছে) অবিশ্বাস করি”। এখানে আপনি দাবি করছেন যে পোষা বিড়ালের অস্তিত্বের ‘প্রমাণের অপ্রতুলতা বা অভাব’ রয়েছে। আর ‘প্রমাণের অপ্রতুলতা’ মানে প্রমাণ পাওয়ার সকল সম্ভাব্য অবস্থা সম্পর্কে আপনি জেনেই নিশ্চিত হয়েছেন যে ‘প্রমাণের অপ্রতুলতা’ আছে। তাই আপনার উচিত কোন কোন সম্ভাব্য প্রমাণের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে আপনি এহেন সিদ্ধান্তে উপনীত হয়েছেন যে পোষা বিড়াল নেই, তা ব্যাখ্যা করা। একইভাবে, নাস্তিকরা যখন বলে ‘আমরা প্রমাণের অভাবে স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করি’ তখন তাদের উচিত সম্ভাব্য কোন কোন প্রমাণের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার বা অবিশ্বাস করে তা ব্যাখ্যা করা।

উদাহরণস্বরূপ, নাদরুন নামের এক ভদ্রলোক বললো, “স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে যে যুক্তি আস্তিকরা প্রধান করে তা আমার কাছে বোধগম্য মনে হচ্ছে না”। এর মানে আপনি যদি মিস্টার নাদরুনকে সষ্ট্রার অস্তিত্বের পক্ষে ভালো কোন যুক্তি প্রদান করতে পারেন তাহলে সে আপনার যুক্তি মেনেও নিতে পারে। এখানে মিস্টার নাদরুন স্রষ্টা আছে নাকি নেই এই বিষয়ে কোনও নিশ্চিত অবস্থান গ্রহণ করেনি। তাই আমরা মিস্টার নাদরুনকে নাস্তিক বলতে পারি না। তার ব্যাপারটি সংশয়ের সাথে যায়। অন্যদিকে, এলেক্স নামের এক ভদ্রলোক বললেন, “স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে আস্তিকরা যে দাবি করে তা আমি অস্বীকার করলাম কারণ স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে আমি কোন প্রমাণ খুঁজে পাইনি”। অস্বীকার করার পর মিস্টার এলেক্সের অবস্থান কি? সে কি মনে করে যে যদি তাকে আরো ভালো কোন যুক্তি-প্রমাণ দেওয়া হয় তাহলে সে স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করবে? নাকি তার অবস্থান হলো, স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণগুলো আমি অস্বীকার করলাম এবং এই ব্যাপারে নিশ্চিত যে স্রষ্টা বা অতিপ্রাকৃতিক সত্তা বলতে আদতে কিছু নেই? মিস্টার এলেক্সের অবস্থান যদি ২নং হয় তবেই তার অবস্থানটি নাস্তিকতার সাথে যায়। এক্ষেত্রে তাকে অবশ্যই প্রমাণ করতে হবে, কোন যুক্তি-প্রমাণের উপর ভিত্তি করে সে এহেন সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে যে, ‘অতিপ্রাকৃতিক সত্তা বলতে আদতে কিছু নেই’। কোন কোন সম্ভাব্য প্রমাণের চুলচেরা বিশ্লেষণ করে সে এহেন সিদ্ধান্ত নিয়েছে যে, ‘স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে প্রমাণের অভাব রয়েছে’? একজন যৌক্তিক মানুষ মাত্রই মিস্টার এলেক্সের কাছে জানতে চাওয়া উচিত স্রষ্টার অস্তিত্ব অস্বীকার করার পক্ষে কি প্রমাণ তার কাছে রয়েছে! যদি তার কাছে কোন যুক্তি প্রমাণ থাকে তাহলে তা শুনা উচিত এবং তার দেওয়া যুক্তিতে যদি কোন ত্রুটিবিচ্যুতি থাকে তাহলে তাকে সে বিষয়ে অবগত করা প্রয়োজন এবং স্রষ্টার অস্তিত্বের যুক্তিগুলো তার কাছে মেলে ধরতে হবে।

আগেই বলেছি যে, আস্তিকরা স্রষ্টার অস্তিত্বের পক্ষে প্রমাণাদি উপস্থাপন করার পর নাস্তিক যদি উপস্থাপিত প্রমাণগুলোকে বৈধ বা যুক্তিযুক্ত মনে না হওয়ার কারণে প্রত্যাখ্যান করে, তাহলে ব্যাপারটি আর নাস্তিক্যবাদের মধ্যে থাকেনা। ‘স্রষ্টার অস্তিত্ব নিয়ে সংশয় আছে’ ব্যাপারটি এমন  এমন একটি অবস্থান বলে বিবেচিত হবে। কেননা, উপস্থাপিত প্রমাণ যদি বৈধ বা যুক্তিযুক্ত হতো বা তার সামনে যদি যুক্তিযুক্ত প্রমাণ উপস্থাপন করা হয় তাহলে সে মেনে নিতো যে, স্রষ্টার অস্তিত্ব আছে। সুতরাং, নাস্তিক হওয়ার মানে, স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করা।

কিছু নাস্তিক, নাস্তিক্যবাদকে জাস্টিফাই করতে এমন যুক্তিও দিয়ে থাকে যে, আমরা স্রষ্টাকে স্বচক্ষে দেখিনি। তাই আমরা স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করিনা। কিন্তু আমি কিছু দেখিনি বলে তার অস্তিত্ব নেই, এই দাবিটিও মূলত অজ্ঞতামূলক ভ্রান্তি। এই ভ্রান্তি নিয়ে ইতোমধ্যেই আমরা বিস্তর আলোচনা করেছি। এছাড়াও, আমাদের দেখার উপরে কোন কিছুর অস্তিত্ব নির্ভর করে না, এবং আমাদের সমস্ত জ্ঞান কেবল মাত্র দেখার উপর ভিত্তি করে হয় না। উদাহরণস্বরূপ, আপনি বিশ্বাস করেন যে, ‘আপনার পূর্ব পুরুষদের অস্তিত্ব ছিল’। কিন্তু আপনি তো কখনোই আপনার পূর্ব পুরুষদের অস্তিত্ব স্বচক্ষে দেখেননি? তাহলে কেন বিশ্বাস করেন? কারণ, যদি আপনার পূর্ব পুরুষদের অস্তিত্ব না থাকতো তবে আপনি অস্তিত্বে আসতে পারতেন না। আপনার পূর্ব পুরুষদের অস্তিত্ব ছিল এটা বুঝতে আপনার স্বচক্ষে দেখে আসা লাগেনি যে আসলেই আপনার পূর্ব পুরুষদের অস্তিত্ব ছিল কি না! আপনার অস্তিত্বই আপনার পূর্ব পুরুষদের অস্তিত্ব প্রমাণ করে। আমাদের সাধারণ বোধ-বিবেচনা বা যুক্তির মাধ্যমে আমরা বুঝে উঠতে পারি আমাদের পূর্ব পুরুষদের অস্তিত্ব ছিল। একইভাবে, আমাদের এই মহাবিশ্বের অস্তিত্বই স্রষ্টার অস্তিত্ব প্রমাণ করে। কারণ, এই মহাবিশ্ব এবং মহাবিশ্বের মধ্যে যা কিছু আছে সব কিছুর অস্তিত্বের জন্য শুরু আছে। অস্তিত্বের জন্য যা কিছুর শুরু আছে তার অস্তিত্বের কারণ (Cause) থাকা অপরিহার্য। সুতরাং, আমাদের সাধারণ বোধ-বিবেচনার মাধ্যমেই আমরা এহেন সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে পারি যে এই মহাবিশ্ব সৃষ্টির জন্য কারণ (Cause) রয়েছে। সুতরাং, আমরা স্রষ্টাকে স্বচক্ষে দেখিনি, তাই আমরা স্রষ্টার অস্তিত্বে বিশ্বাস করিনা, এই দাবিটিও যৌক্তিক নয়।

নাস্তিক্যবাদকে জাস্টিফাই করতে কিছু নাস্তিক এমন যুক্তির আশ্রয় নিয়ে থাকে যে, ধর্মগ্রন্থে ভুল তথ্য দেওয়া হয়েছে, সাংঘর্ষিক মূলক কথা বলা হয়েছে, অবৈজ্ঞানিক কথা বলা হয়েছে, ইত্যাদি। এই যুক্তিতে আগে থেকেই ধরে নেওয়া হয় যে, যদি ধর্মগ্রন্থগুলি ভুল হয়, তবে নাস্তিকতা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সঠিক হতে হবে। তাই এই দাবিটিতে একজন নাস্তিক মূলত ফলস ডাইকোটমি ফ্যালাসি (False Dichotomy Fallacy) করে থাকে। ফলস ডাইকোটমি ফ্যালাসি এমন একটি কুযুক্তি যেখানে ধরে নেওয়া হয় যে, একটি পরিস্থিতির জন্য কেবল দুটি বিকল্প রয়েছে বা অন্য কোনো সম্ভাবনা নেই। যেমন, হয় তুমি ভালো ছাত্র, অন্যথায় তুমি ব্যর্থ। এখানে ধরে নেওয়া হচ্ছে যে একজন ছাত্র হয় ভালো হতে পারে অথবা ব্যর্থ হতে পারে। কিন্তু একজন ছাত্র ভালো না হলেও সফল হতে পারে। তাই ‘হয় তুমি ভালো ছাত্র, অন্যথায় তুমি ব্যর্থ’ এই দাবিটি একটু কুযুক্তি। একইভাবে ‘ধর্মগ্রন্থগুলি ভুল, তাই নাস্তিকতা সঠিক’ এই দাবিটি False Dichotomy Fallacy. কারণ এটি ধরে নিচ্ছে যে কেবল দুটি বিকল্প রয়েছে এবং অন্য কোনো সম্ভাবনা নেই।

ধর্মগ্রন্থে ভুল থাকলে নাস্তিক্যবাদ সত্য বলে প্রমাণিত হয় না। কারণ কোনো একটা মতবাদের সত্যতা তার বিপক্ষ কোনো মতবাদের ভুল হওয়ার মধ্যে নিহিত নয়। উদাহরণস্বরূপ, একজন শিক্ষক ক্লাসের দশজন ছাত্রকে একটি অঙ্ক করতে বললো। ছাত্রদের অঙ্ক করা শেষ হওয়ার পর শিক্ষক দেখলেন প্রথম পাঁচ জনের অঙ্কই ভুল হয়েছে। প্রথম পাঁচ জনের অঙ্ক ভুল হওয়া কি কোনোভাবেই প্রমাণ করে যে, বাকি পাঁচ জনের অঙ্ক সঠিক হবে? আমাদের সাধারণ বোধ-বিবেচনা থেকেও আমরা বুঝতে পারি পাঁচ জনের অঙ্ক ভুল হওয়া কখনো এটা প্রমাণ করেনা যে, বাকি পাঁচ জনের অঙ্ক সঠিক। বরং, বাকি পাঁচ জন সঠিক নিয়মে অঙ্ক করেছে কি-না তার উপর নির্ভর করে ফলাফল সঠিক নাকি ভুল। তাই নাস্তিকদের তাদের অবস্থানকে সত্য প্রমাণ করার জন্য এমন কোনো যুক্তি উপস্থাপন করতে হবে যা নাস্তিকতাকে সমর্থন করে। অন্য কোনো মতবাদ বা কোনো ধর্মের ভুল হওয়া কিছুতেই প্রমাণ করেনা যে নাস্তিকতা সত্য। তাই ‘ধর্মগ্রন্থগুলি ভুল, তাই নাস্তিকতা সঠিক’ এই দাবিটি একটি নন সিক্যুইটার ফ্যালাসি (non sequitur fallacy). নন সিক্যুইটার ফ্যালাসি এমন একটি কুযুক্তি যেখানে বলতে বুঝানো হয়, প্রেমিস সিদ্ধান্তেকে জাস্টিফাই করে না। যেমন, আমি নতুন জুতা কিনেছি, তাই আমি পরীক্ষায় ভালো ফলাফল করব। এটি একটি নন সিক্যুইটার ফ্যালাসি। কারণ, পরিক্ষায় ভালো ফলাফল করার সাথে নতুন জুতা কেনার কোনো সম্পর্ক নেই। একইভাবে ধর্মগ্রন্থগুলোর মধ্যে ভুল থাকার সাথে নাস্তিকতার সত্য হওয়ার কোনো সম্পর্ক নেই। তাই ‘ধর্মগ্রন্থগুলি ভুল, তাই নাস্তিকতা সঠিক’ এই দাবিটিও একটি নন সিক্যুইটার ফ্যালাসি।

পরিশেষে আমরা বলতে পারি, নাস্তিক্যবাদ স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। কিন্তু এখন পর্যন্ত তারা স্রষ্টার অস্তিত্বকে অস্বীকার করার জন্য সঠিক যুক্তি-প্রমাণ উপস্থাপন করতে ব্যর্থ  হয়েছে। তাদের দাবির পক্ষে যে-সব যুক্তি উপস্থাপন করা হয় (স্রষ্টার অস্তিত্বের প্রমাণ পায়নি, ধর্মগ্রন্থগুলো ভুল, ইত্যাদি) তা মূলত কুযুক্তি।

তবে দুর্ভাগ্যজনকভাবে, কিছু নাস্তিক ইচ্ছাকৃতভাবে অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবে, সরাসরি বা পরোক্ষভাবে নাস্তিকতা ও সংশয়বাদ এবং  অ্যাগনস্টিসিজম এর সীমারেখা গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন। যদি নাস্তিকতাকে সংশয়বাদ এবং অ্যাগনস্টিসিজম এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়, তাহলে নাস্তিকরা নিজেদের অবস্থানের পক্ষে প্রমাণ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করতে পারে। তাই এই বিষয়টি গভীরভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন এবং আমাদের নাস্তিক্যবাদ ও অ্যাগনস্টিসিজম সম্পর্কে বিস্তারিত জানা প্রয়োজন।

একই সাথে নাস্তিক এবং অ্যাগনস্টিক?

যেহেতু কিছু নাস্তিক ইচ্ছাকৃতভাবে অথবা অনিচ্ছাকৃতভাবে, সরাসরি বা পরোক্ষভাবে নাস্তিকতা এবং  অ্যাগনস্টিসিজম এর সীমারেখা গুলিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেন এবং দাবি করেন তারা অ্যাগনস্টিক এথিস্ট! কারণ যদি নাস্তিকতাকে সংশয়বাদ এবং অ্যাগনস্টিসিজম এর সঙ্গে গুলিয়ে ফেলা হয়, তাহলে নাস্তিকরা নিজেদের অবস্থানের পক্ষে প্রমাণ দেওয়ার প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করতে পারে। অর্থাৎ, নাস্তিকরা নিজেদের উপর থেকে প্রমাণের বোঝা ছুড়ে ফেলে দেওয়ার জন্যই এমন ছলনার আশ্রয় নিয়ে থাকে। তাই এই বিষয়টি গভীরভাবে আলোচনা করা প্রয়োজন এবং আমাদের নাস্তিক্যবাদ ও অ্যাগনস্টিসিজম সম্পর্কে বিস্তারিত জানা প্রয়োজন।

মেরিয়াম ওয়েবস্টার অভিধান অনুসারে একজন অ্যাগনস্টিক হলো সেই ব্যক্তি, যার মত হলো যে কোনো চূড়ান্ত বাস্তবতা—যেমন ঈশ্বর—মানুষের কাছে অজানা এবং সম্ভবত জানা সম্ভবও নয়। সাধারণভাবে বলতে গেলে, একজন সংশয়বাদী এমন কেউ যিনি ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা অনস্তিত্ব—এই দুই অবস্থানের কোনোটির পক্ষেই পুরোপুরি নিশ্চিতভাবে বিশ্বাস পোষণ করেন না। 6

অক্সফোর্ড ইংলিশ ডিকশনারি (OED) অনুযায়ী, একজন অ্যাগনস্টিক হলো এমন ব্যক্তি, যিনি বিশ্বাস করেন যে অদৃশ্য বা অধিবাস্তব জিনিস সম্পর্কে—বিশেষ করে ঈশ্বরের অস্তিত্ব বা তাঁর প্রকৃতি সম্পর্কে—কিছুই জানা যায় না বা জানা সম্ভব নয়। 7

ক্যামব্রিজ ডিকশনারি (Cambridge Dictionary) অনুযায়ী, একজন অ্যাগনস্টিক হলো এমন একজন ব্যক্তি, যিনি জানেন না অথবা মনে করেন যে জানা সম্ভব নয়—ঈশ্বর আছেন কি না। 8

এই সংজ্ঞাগুলোর মধ্যে কিছু পার্থক্য থাকলেও মূলত সবগুলোই এই অর্থ প্রকাশ করে যে একজন অ্যাগনস্টিক হচ্ছেন এমন ব্যক্তি যিনি না আস্তিক (ঈশ্বরের অস্তিত্বে বিশ্বাসী), না নাস্তিক (ঈশ্বরের অস্তিত্ব অস্বীকারকারী)। অ্যাগনস্টিক এমন কেউ, যিনি উভয় সম্ভাবনাই বিবেচনা করেছেন কিন্তু নিশ্চিত নন—বা কখনো কখনো বিষয়টি সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ—অথবা যিনি মনে করেন, ঈশ্বরের অস্তিত্ব কখনোই জানা সম্ভব নয়। এর মাধ্যমে অ্যাগনস্টিকিজমের দুইটি স্তর বোঝা যায়। যেমন, “হার্ড অ্যাগনস্টিকিজম” এবং “সফট অ্যাগনস্টিকিজম”। 

রেফারেন্স
  1. Atheism and Agnosticism (Stanford Encyclopedia of Philosophy) []
  2.  Atheism Definition & Meaning – Merriam-Webster []
  3.  ATHEISM | meaning, definition in Cambridge English Dictionary []
  4. Graham Oppy; ATHEISM AND AGNOSTICISM; Page; 4-5 (Cambridge University Press) []
  5. Richard Dawkins; The God Delusion; P-14 []
  6. AGNOSTIC Definition & Meaning – Merriam-Webster []
  7. agnostic, n. & adj. meanings, etymology and more | Oxford English Dictionary []
  8. AGNOSTIC | English meaning – Cambridge Dictionary []
0 0 votes
Article Rating
Subscribe
Notify of
guest
0 Comments
Oldest
Newest Most Voted
Inline Feedbacks
View all comments
Scroll to Top
0
Would love your thoughts, please comment.x
()
x